নাক কেটে যুদ্ধ জয়

নাক কেটে যুদ্ধ জয়



প্রবাদ বাক্যে আছে-
নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা। কিন্তু প্রাচীন পারস্যের এক সেনাপতি নিজের নাক আর কান কেটে শুধু যাত্রাভঙ্গ করা নয়, আস্ত একটি যুদ্ধ জয় করে ফেলেছিলেন। এই সেনাপতির নাম ছিলো জোপীরোস (Zopyros)। ঘটনাটি ঘটেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৫১৯ অব্দে পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের (Darius) রাজত্বকালে।

দারায়ুস ছিলেন পারশ্যের এক শক্তিশালী সম্রাট। পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখল করে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে স্থাপন করেছিলেন এক বিশাল সাম্রাজ্য।

সম্রাট দারায়ুস খ্রিঃ পূঃ ৫১৯ অব্দে আক্রমণ করলেন ব্যাবিলন শহর। তিনি অবরোধ করে রাখলেন শহরটি।

কিন্তু ব্যাবিলন শহরটি ছিলো অত্যন্ত সুরক্ষিত। সহজে কাবু করা গেলো না নগরবাসীদের। দীর্ঘ ২০ মাস অবরোধ করার পরেও নগরের শাসনকর্তা আত্মসমর্পণ করলেন না।

এদিকে অস্থির হয়ে পড়লো পারসিয়ান বাহিনী নিজেই। অবরোধ করে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়লো তারা। অথচ শহর বাসীরা আত্মসমর্পন করছেনা।


অবরোধকারী এই পারসিয়ান বাহিনীরই অন্যতম প্রধান সেনাপতি ছিলেন জোপীরোস।

আসলে জোপীরোস নিজেই বেশি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। কেমন করে ব্যাবিলনীয়দের কাবু করা যায় তা নিয়ে খুব ভাবতে লাগলেন । তারপর যা করার তার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন ।

তিনি করে ফেললেন এক অদ্ভুত কাণ্ড । রাতের বেলা সহসা নিজের কোমরের তরবারি দিয়ে নিজেই কেটে ফেললেন নিজের নাক এবং কান।

তারপর ঘটালেন আরো দুঃসাহসিক কাণ্ড। তিনি নাক-কান কাটা রক্তাক্ত অবস্থায়ই সোজা দৌড়ে গেলেন ব্যাবিলন নগরীর দিকে। তারপর চিৎকার দিতে দিতে ঢুকে পড়লেন সোজা নগরীর অভ্যন্তরে। ধরা দিলেন 

শত্রুদের হাতে।

-

জোপীরোস কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, – আমি এসেছি পারসিয়ানদের শিবির থেকে। আমি তোমাদের শত্রুপক্ষের লোক। কিন্তু এখন আর আমি তোমাদের শত্রু নই। আমি তোমাদের আশ্রয় চাই। —কিন্তু তোমার এমন অবস্থা করলো কে?

—এমন অবস্থা করেছে ওই পারশিয়ানরাই। ওরাই আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো।

-কেনো? কেনো তোমাকে ওরা হত্যা করতে চেয়েছিলো? কি করেছিলে তুমি?

-সে অনেক কথা। তোমরা শুনলে দুঃখ পাবে। তোমাদের কারণেই ওরা আমাকে এই অপমান করেছে।

-আমাদের জন্য কেনো?


- পারসিয়ানরা আজ বিশ মাস ধরে তোমাদের শহর অবরোধ করে আছে। ওরা ভেবেছিলো তোমরা সহজেই আত্মসমর্পণ করবে।

-কিন্তু না, আমরা বিদেশী শত্রুর হাতে কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবো না। এতে যদি ব্যাবিলনের সবলোক মরেও যায়, তবু না।

জোপীরোস তেমনি নিজের নাক চেপে ধরে বলতে লাগলেন,- সেই . জন্যই তো ওরা অস্থির হয়ে পড়েছে। ওরা হিংস্র হয়ে উঠেছে।

-তা হোক।

-কিন্তু আমি তো চাই না। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তোমরা যখন আত্মসমর্পণ করছোই না, তখন তোমাদের সাথে একটা সন্ধিতে আসা যায়। কিন্তু ওরা বলেছিল, তা হবে না। ওদের ব্যাবিলন আমরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবো, হত্যা করবো সমস্ত লোক। আমি বাধা দেয়াতেই ওরা আমাকে তোমাদের গুপ্তচর বলে গালি দিয়েছে এবং আমার নাক- কান কেটে দিয়েছে।

এই কথা শোনার পর ব্যাবিলনের শাসনকর্তার মন সত্যি এবার নরম হয়ে এলো।

তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, - তবে তো সত্যি খুব দুঃখের কথা। তোমার মতো দয়ালু লোককে ওরা এমন অপমান করলো?

-অপমান? আমি এ অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে তবে ছাড়বো। আমি একটি পারসিয়ানকেও আর জীবিত ফিরতে দেবো না। ওদের কতো শক্তি তা আমি সব জানি।

ওদের ঘাঁটির সব গোপন তথ্য আমার জানা আছে। আমাকে সাহায্য করুন জাঁহাপনা। আমি ওদের সব কটার মাথা কেটে এনে আপনার পায়ের তলায় রাখবো। তবে আমার মনের জ্বালা মিটবে।

ব্যাবিলনের শাসনকর্তা দেখলেন, এটা সত্যি বড় সুযোগ। এবার তাহলে হয়তো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যাবে। ওদের লোক দিয়েই ওদেরকে ঘায়েল করা যাবে।

তাই তিনি জোপীরোসকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, – বেশ, বেশ, তাই হবে। তোমার মতো ভালো লোককে যারা দেখতে পারলো না, তাদের


উচিত শাস্তিই হওয়া দরকার। আর সে শান্তি তুমি তোমার নিজের হাতেই

দেবে।

আমি তোমাকে এই নগরীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলাম। তুমি এবার তোমার অপমানের প্রতিশোধ নেবে।

আসলে মনে মনে এটাই তো কামনা করছিলেন জোপীরাস। তিনি চাকরি পেলেন ব্যাবিলন সেনাবাহিনীতে এবং মাসখানেক খুব বিশ্বস্ততার ভান করলেন ওদের সাথে। রাতদিন শুধু পারসিয়ান দের মুণ্ডুপাত করতে লাগলেন। আর যুক্তি করতে লাগলেন কেমন করে পারসিয়ানদের ঘাঁটি

আক্রমণ করা যায় ।

তিনি জোর দিয়ে বুঝাতে লাগলেন, পারসিয়ানদের আসলে কোনো শক্তি নেই। ওদের কোথায় কি আছে সব আমার জানা। শুধু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই হলো।

তারপর সত্যি সত্যি একদিন তাই করে ফেললেন জোপীরোস। তিনি প্রধান প্রধান ব্যাবিলনীয় সৈন্যদের জড়ো করে একটি বাহিনী তৈরি করলেন। তারপর সুকৌশলে খুলে দিলেন নগরীর সব দ্বার।

তারপর নিজের সৈন্যদের নিয়ে নগরী ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। আর এই সুযোগে খোলা দরোজা দিয়ে পারসিয়ানরা ঢুকে পড়লো নগরীর

ভেতরে।

জোপীরোসের বাহিনীও করলো আত্মসমর্পণ। তখনি ব্যাবিলনীয়রা বুঝতে পারলো ছদ্মবেশী জোপীরোসের সব চালাকি। কিন্তু তখন তো আর কিছু করার ছিলো না। সর্বনাশ যা ঘটার ঘটে গেছে।

এমনি করে শুধু জোপীরোসের দুঃসাহসিক কাজের ফলেই পারসিয়ানদের হলো জয়, পতন ঘটলো ব্যাবিলন নগরীর।।

এই প্রশংসনীয় সংবাদ গিয়ে অবশেষে পৌঁছলো সম্রাট দারায়ুসের কানে। তিনি সব ঘটনা শুনে শুধু খুশি নয়, চমৎকৃত হলেন ।

তিনি নিজেই সেনাপতি জোপীরোসের প্রশংসা করে বললেন, সাবাস জোপীরোস! অমন ২০টি ব্যাবিলন নগরীর চেয়েও অধিক মূল্যবান হলো জোপীরোসের মতো দুঃসাহসী ও আত্মত্যাগী একজন সেনাপতি।

তারপর সম্রাট দারায়ুস পরম খুশি হয়ে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিলেন সেনাপতি জোপীরোসকে।

বিলিভ



Comments